ফেলে আসা দিনগুলো বাংলা রচনা

ফেলে আসা দিনগুলো অথবা কোথাও আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা অথবা শৈশব স্মৃতি।     ভূমিকাঃ অতীত স্মৃতি মানুষকে মাঝে মাঝে ভাবিয়ে তুলে – হো...

ফেলে আসা দিনগুলো
অথবা
কোথাও আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা
অথবা শৈশব স্মৃতি।

 

 

ভূমিকাঃ অতীত স্মৃতি মানুষকে মাঝে মাঝে ভাবিয়ে তুলে – হোক তা অবিমিশ্রিত দুঃখের কিংবা আনন্দের। জীবনে চলার পথে এগিয়ে যেতে মানুষকে বারবার অতীত বা পেছনে ফিরে তাকাতে হয়। ভালো লাগে অবসরে অতীতের ফেলে আসা দিনগুলোর আনন্দ বেদনার স্মৃতি রোমন্থন করতে। মানব স্মৃতির পটে জমা থাকে শৈশব ও কৈশোরের অসংখ্য ছোট বড় অসংখ্য ঘটনা প্রবাহ। তার কতগুলো মন থেকে আপনাআপনি মুছে যায়, আবার কতগুলো উজ্জ্বল হয়ে জেগে থাকে মনের মণিকোঠায়। যে সময়ের স্মৃতিগুলো মানুষের মনে সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে বিরাজ করে, তা হলো শৈশবকাল।

 

 

আমার শৈশবকালঃ আমার শৈশব কেটেছে গ্রামে, কুমিল্লা জেলার ছোট্র শান্ত একটি গ্রাম- বিরানপুর। গ্রামটির নাম কিভাবে যে বিরামপুর হয়েছিল, তা বলা কঠিন। তবে কথিত আছে, বিশাল বিলের মাঝে নিস্তব্ধ এ গ্রামটি গড়ে উঠেছিল বলে একে বিলেরপুর নামকরণ করা হয়। কালক্রমে এটা বিরানপুর নামে পরিচিত লাভ করে। গ্রামে যখন শৈশব কেটেছে তখন সে সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবতে শিখিনি। কিন্তু আজ স্মৃতিপটে মনে পড়ে- বিরানপুরের কত না সুন্দর ভোর হতো, সকাল সন্ধ্যা কত না সুন্দর পাখিরা গাইতো। ডানপিটে ছেলে হিসেবে যে কয়জন ছেলে গ্রামময় ঘুরে বেড়াত, ঝড়ের দিনে আম কুড়ানোর প্রতিযোগিতায় মেতে উঠত, কিংবা হিজল গাছের চূড়া থেকে পানিতে লাফিয়ে পড়ত, আমি ছিলাম তাদের মধ্যে অন্যতম।

 

শৈশব লেখাপড়াঃ শৈশব লেখাপড়া ছিল নামমাত্র। আমি বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে বলে তারা কখনো আমাকে লেখাপড়ার জন্য মার কিংবা বকুনি দিতেন না। আমার বড় বোন সকাল সন্ধ্যা অক্ষর পরিচয় কিংবা ছড়া পড়াতে বসতেন। ঘরে বর্ণপরিচয় পাঠ শেষ হলে একদিন ইংরেজি বছরের প্রথমে বাবা নিয়ে গেলেন গাঁয়ের একমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রধান শিক্ষক মহোদয় স্কুলের খাতায় আমার নাম উঠালেন এবং রীতিমতো স্কুলে আসার উপদেশ দিয়ে আদর করলেন। প্রথম প্রথম স্কুলের গন্ডিবদ্ধ জীবন, আর অপরিচিত পরিবেশে আমার মোটেই ভালো লাগে নি। তবে পরবর্তীতে শিক্ষকদের স্নেহ এবং সমবয়সী ছেলেমেয়েদের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠায় সহজেই মনের জড়তা কেটে যায়।

 

 

শৈশবে স্কুল পালানোঃ শৈশবে স্কুল পালানো ছিল একটা স্বাভাবিক ব্যপার। পাড়ার দুষ্ট ছেলেদের পাল্লায় পড়ে প্রায়ই স্কুল পালানোর সিদ্ধান্ত নিতাম। বাবা মাকে স্কুলে না যাওয়ার কথা জানালে তারা কখনোই তা সমর্থন করতেন না। তা পেট ব্যথা কিংবা মাথা ব্যাথার মিথ্যা অজুহাত তুলে তাদের সমর্থন আদায় করতাম। কখনো বইপত্র নিয়ে স্কুলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতাম ঠিকই, কিন্তু পথে কোথাও বই লুকিয়ে রেখে বন্ধুদের নিয়ে চলে যেতাম মাঠের ওপারে রেল লাইনে। এভাবে সকাল গড়িয়ে বিকাল হলে কাদা মাখা শরীরে বাড়িতে ফিরতাম। আর তখনই শুনতে হতো মায়ের শাসনের সুরে আদরমাখা বকুনি। এরূপ শৈশবকে স্মরণ করেই হয়তো কবি জসিমউদ্দিন লিখেছেন_

 

“ওরে মুখ-পোড়া ওরে রে বাঁধর

গালি-ভরা মার অমনি আদর”।

শৈশবে খেলাধুলাঃ পূর্বেই বলা হয়েছে, শৈশব এ লেখাপড়া ছিল নামমাত্র, তখন দুষ্টুমি আর খেলাধুলাতেই কেটে গেছে দিনের বেশির ভাগ সময়। পাড়ার ছেলেদের সাথে জমে উঠত কানামাছি, হাডুডু, গোল্লাছুটসহ আরো কত খেলা। বার্ষিক পরীক্ষার পর স্কুলেও খেলাধুলার প্রতিযোগিতা হতো। দৌড়, সাঁতার এবং দীর্ঘ লাফে সব সময় আমি প্রথম হতাম। মনে পড়ে, প্রতিযোগিতায় প্রাপ্ত পুরস্কারগুলো নিয়ে যখন মায়ের হাতে দিতাম, তখন খুশিতে আত্মহারা হয়ে তিনি কপালে চুমু খেতেন। আর মনে পড়ে প্রশস্ত উঠানে বসে চাঁদনি রাতে দাদিমা রাক্ষস-খোক্কস আর রাজপুত্রের গল্প শোনাতেন। এমনি রাতে অনেক সময় মুখে মুখে ছড়া কেটেছি আর সমবয়সীদের নিয়ে খেলার আসর জমিয়েছি…

 

“ওপেন টু বায়স্কোপ

রায়টনে টেলেস্কোপ

চুলটানা বিবিয়ানা

সাহেব বাবুর বৈঠকখানা”।

 

কৈশোরের কথাঃ আমদের পাশের গ্রামে ছিল মাধ্যমিক বিদ্যালয়। কৈশোর কেটেছে সে স্কুলের গন্ডিতেই। স্কুলটিকে কেন্দ্র করে সেখানে জীবনপ্রবাহ চঞ্চল হয়ে উঠলেও তা ছিল অনেকাংশ নিরিবিলি। প্রকৃতপক্ষে, লেখাপড়া শুরু হয় তখনই। শিক্ষকদের কড়া শাসন স্কুলের সুনাম বয়ে এনেছিল। আর সৃষ্টি হয়েছিল ভালো ফলাফলের ঐতিহ্য। স্কুল জীবন ছিল আনন্দের সমারোহে উৎফল্ল। স্কুলে ছিল নিয়মিত ক্লাস আর পড়ার চাপ, ছিল চমৎকার একটি গ্রন্থাগার। আমাদের স্কুলে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে ছিল, ছিল একটি নিয়মিত দেয়াল পত্রিক। ছোট ছোট গল্প-কবিতা লেখার মধ দিয়েই আমার প্রথম লেখার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। দেখতে না দেখতেই কেটে গেল স্কুলের পাঁচটি বছর। এলো এসএসসি পরীক্ষা। পরীক্ষার পূর্বেই আমাদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্কুল থেকে বিদায় দেওয়া হলো। সহপাঠীদের সাথে গড়ে উঠেছিল আমাদের আত্মার সম্পর্ক। শিক্ষকদের আদরমাখা শাসন আর ভালোবাসা পেয়ে ভুলেই গিয়েছিলাম, একদিন স্কুল থেকে আমাদেরকে বিদায় নিতে হবে। তাই বিদায় নিতে গিয়ে সেদিন আমরা কেউ চোখের পানি সংবরণ করতে পারি নি। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না!

 

 

স্মরণীয় একটি ঘটনাঃ তখন আমি নবম শ্রেণিতে পড়ি। দশম শ্রেণীতে পড়তেন আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রামের হাসান ভাই। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। কথাবার্তা ও আচার আচরণে তিনি ছিলেন বিনয়ী। গান পরিবেশন ও আবৃতিতে তার জুড়ি ছিল না। কিন্তু হঠাত তার জীবনে নেমে এলো এক অনাকাংকিত বিপর্যয়। অতি বিনয়ী এ ছেলেটি একদা শ্রেণীকক্ষে হয়ে উঠলেন বেপরোয়া। কখনো কাঁদেন, কখনো অট্রহাসিতে ফেটে পড়েন। এমনকি এক পর্যায়ে তিনি সহপাঠীদের উপরও চড়াও হতে শুরু করলেন। এ খবর জানতে পেরে প্রধান শিক্ষক মহোদয় ছুটে আসেন। তিনি কেরানিকে পাঠান ডাক্তার ডাকার জন্য। যথাসময়ে ডাক্তার আসেন এবং তাকে পরীক্ষা করে মস্তিষ্ক বিকৃত ঘটেছে বলে জানান। এরপর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো, অনেক রকম চিকিৎসা দেওয়া হলো, কিন্তু তিনি আর সুস্থ হলেন না। হাসান ভাইয়ের কথা মনে হলে এখনো কষ্ট হয়। শুনেছি, এখনো তিনি মাঝে মাঝে স্কুলের মাঠে আসেন এবং বিড়বিড় করে কি যেন বলতে থাকেন।

 

 

স্মৃতিকাতর আমিঃ জীবনের অমোঘ টানে আমি এখন শহরবাসী। গ্রামের মুক্ত জীবনেও এখন নাগরিক উপকরণ ও যান্ত্রিকতা প্রবেশ করেছে। তা সত্ত্বেও আমার শৈশবের স্মৃতি আমাকে পোড়ায়। সেই মুক্ত বিহঙ্গের মতো দিনগুলো যদি ফিরে আসতো !। সেও মুক্তাকাশের নিচে এক দুরন্ত কিশোরের প্রাণখোলা হাসি, বন্ধনহীন জীবনের আস্বাদ কি আর ফিরে আসবে। এখনো আমি গ্রামের পাশে মাঠের সোঁদা গন্ধ, পাকা ধানের নেশা জাগানিয়া সুবাস পাই। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর কল কল স্রোত আমাকে ভাসিয়ে নিতে চায়। নগর জীবনের চৌহদ্দিতে বসে আমি শুধুই স্মৃতিকারতায় ভুগি, কখনো কখনো কষ্টও পাই।

 

 

উপসংহারঃ পৃথিবীর অমোঘ নিয়মে সবকিছু পরিবর্তন হয়ে যায়। সকালের ঝকঝক রোদ দুপুরে গড়ায়, দুপুর গড়িয়ে অপরাহ্ণের ছায়া দীর্ঘতর হয়, অতঃপর নামে রাতের আঁধার। মানুষের জীবনেও তেমনি শৈশব, কৈশোর ও যৌবন পেরিয়ে বার্ধক্যে উপনীত হয়। ফেলে আসা দিনগুলো তখন অতীত হয়ে দোলা দেয় মনের গহীন কোটরে। শৈশব-কৈশোরের আনন্দময় দিনগুলোর স্মৃতি হৃদয়ে এমনভাবে গেঁথে থাকে, যা কখনো মুছে ফেলা যায় না। তাই অনেকেই অবসর সময়ে অতীতে ফেলে আসা দিনগুলোর হিসাবে মেলাতে চান।

COMMENTS

Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Readmore Reply Cancel reply Delete By Home PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy Table of Content